সময়টা ছিল মহান একুশে বইমেলা ২০১১। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে গেছে এ অমর একুশে বইমেলা। শীতের আমেজ আর ছুটির আবেশে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে ঘুরছি আর বিভিন্ন স্টলে দেখছি নতুন আসা বইগুলো। বিভিন্ন ধরণের বই! বিষয় বৈচিত্রে ভরপুর!
ছোটবেলা থেকে আমরা জানি জার্মানির ফ্রঙ্কফুটের বিখ্যাত বইমেলার কথা। আর পার্শ্ববর্তী কোলকাতার বইমেলার বাংলাদেশী স্টলের নানা গল্প বিভিন্ন লেখায় পড়েছি। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় আমরা কয়েকজন মিলে মিনার্ভা পাবলিকেশন্সের স্টল দিতাম। আর নানা প্রকার বই বিভিন্ন স্টল থেকে এনে বিক্রি করতাম। দিন শেষে ভাল লাভও থাকতো! আর তা হলে যাবার সময় খরচ করতাম। মেলার মাস শেষে হাতে বেশ কিছু টাকাও জমে যেত।
যাইহোক, স্টলে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ রাতুল প্রকাশনীর একটা বইয়ের প্রচ্ছদে আমার চোখ আটকে গেল। প্রচ্ছদটি মনসুর উল করিমের চিত্রকর্ম অবলম্বনে আঁকা। বইয়ের নাম “বন্ধন”, লেখক এস. আরিফ; একদম নতুন। এটাই তার প্রকাশিত প্রথম ছোটগল্পের বই।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হবার কারনে নতুন নতুন গল্প, উপন্যাস, ছোট গল্প, প্রবন্ধ রচনা, ভ্রমন কাহিনী, সমালোচনা বা এ ধরনের বই দেখতে আমার অত্যন্ত আগ্রহ বহুদিন থেকেই। কেননা নতুন মানেই প্রতিশ্রুতিশীল, নতুন মানেই প্রগতিশীল, নতুন মানেই পরিবর্তন- এ আশা আমি সর্বদা করি। আর তাই আমি এই সব নতুন লেখকদের সম্মান করি এবং অত্যন্ত উৎসাহ নিয়েই তাদের বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো উল্টাই। আর তাছাড়া আরো একটি কারন আছে- বিশ্ব সাহিত্যেও সাথে আমার দেশের লেখা মেলাই, দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য বোঝার চেষ্টা করি। সুতরাং স্বভাবতই আমার দৃষ্টিতে আসা এ বইটি হাতে নিয়ে দেখা শুরু করি। আমার আবার একদম প্রথম শব্দ ও প্রথম লাইন থেকে সব দেখা অভ্যাস! অত্যন্ত অবাক হলাম লেখক একজন বাংলা অনার্সের ছাত্র! আর তাও আবার আমার বাগেরহাটের ছেলে! রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. নীলিমা ইব্রাহীম ও আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের পরই বোধহয় এ এলাকার কেউ এমন লেখালেখিতে জড়ালো। হয়তো আরো অনেক থাকতে পারে তবে আমার জানা নেই। এ এক প্রকার দুঃসাহসই বলা চলে! প্রকাশকের বক্তব্য পড়া পুরো শেষ না করেই বইটি উল্টিয়ে ৭ পৃষ্ঠার প্রথম গল্প “বিজয়ের অপেক্ষা”য় চোক রাখি। স্টলে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বেশি পড়া যায় না। যেটুকু পড়লাম তাতে আমার মনে হলো লেখকের ভেতরে একটা জ্বালা বা অর্ন্তদহন আছে- যেটা একজন প্রতিশ্র“তিশীল লেখক হবার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। স্টলের ছোকড়াদের আর বিরক্ত না করে বইটি কিনে বাসায় চলে আসি।
ঢাকায় আরো কযেকদিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলাম। অবশেষে ছুটি শেষ; ক্লাস শুরু হলে ছাত্র-ছাত্রীরা ফোন করে জ্বালিয়ে মারবে আমাকে। মোবাইল ফোনের এ এক বিড়ম্বনা। সুইচ অন করলেও সমস্যা; আর সুইচ অফ করলেতো আমি সমস্ত পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন!
তাড়াহুড়ো করে ঢাকা থেকে চলে আসার কারনে বইটি আর খুলে দেখতে পারি নি। এক অবসর সময়ে আবার খুলে বসলাম। এ বয়সেও আমার প্রচন্ড পড়াশোনা করার নেশা যায় না। বাসায় বসে পড়ার সময় কম; তাই আমার কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের অফিসে বসে পড়া শুরু করলাম। ছোট ছোট গল্প, কিন্তু তা শেষ করতেই আমার রাত ৪টা! আশ্চর্য! প্রায় এক নিঃশ্বাসেই পড়া শেষ করলাম বলা চলে। এর পর প্রায় এক সপ্তাহ আমি আর এই বইয়ের ধারে কাছেও যাইনি।
ইংলিশ কবি William Wordsworth, Preface to Lyrical Ballads এ বলেছেন, “Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings: it takes its origin from emotion recollected in tranquility: the emotion is contemplated till by a species of reaction the tranquility gradually disappears, and an emotion, kindred to that which was before the subject of contemplation, is gradually produced, and does itself actually exist in the mind.” সুতরাং আমি বই পড়া শেষ করেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এ বইটির উপরে কিছু লিখবো এবং এর লেখকের সাথে পরিচিত হবো।
আমি আবার বইটি পড়লাম। কাহিনীর এত বৈচিত্রতা লেখক যে কোথা থেকে পেলো তা আমার বোধগম্য নয়। তবে নিষ্ঠুর বাস্তবতা যে লেখার সর্বত্রই; তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি অনেক প্রকারে চেষ্টা করলাম সাহিত্যের বিভিন্ন থিওরীর সাথে এ লেখাগুলো মেলাতে। এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক ও লেখক জ্যঁ দেরিদার কথা মনে পড়লো। Deconstruction থিওরী! “A technique of literary analysis that regards meaning as resulting from the differences between words rather than their reference to the things they stand for. Different meanings are discovered by taking apart the structure of the language used and exposing the assumption that words have a fixed reference point beyond themselves” সংক্ষেপে অর্থ হলো সাহিত্যে ব্যাখ্যা নির্ভর করে পাঠকের ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপরে। এ বইয়ে মোট ৮টি ছোট গল্প আছে। আর প্রত্যেকটি গল্প আমাদের ঘুনে ধরা ক্ষয়িষ্ণু সমাজের রন্ধ্রের দূর্ণীতি, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অসামাজিকতা, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার তথা সমাজ ও জাতি ধ্বংসের যত প্রকার উপকরণ দরকার তা আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে বিদ্যমান- তরুণ লেখক এস. আরিফ তা আমাদের হলুদ চোখকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে দেখিয়েছেন। আর তাই আমি তাকে সালাম জানাই।
এজন্যই আমি তরুণদের সম্মান করি, ভালোবাসি ও উৎসাহ দেই। কেননা বড়রা বা বেশি শিক্ষিতরা বা বুদ্ধিজীবিরা আজ ক্ষমতাসীনদের তাবেদারী ও তোষামোদীতে ব্যস্ত। দেশ বা সমাজের অধঃপতন বা ধংস দেখেও না দেখার ভান করে বা এহেন কাজেই ব্যস্ত ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। সমস্ত পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে আজ উন্নতির দিকে আর আমরা এই তরুণ লেখকদের গল্প লেখার প্লট তৈরী করে দেবার কাজে আকণ্ঠ নিমগ্ন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে লেখকের লেখনীকে সাধুবাদ জানাই। আমি কোনো সাহিত্যিক বিশ্লেষক না। মন দিয়ে ভালো লেগেছে বলেই আমার মূল্যায়ন ব্যক্ত করার এ প্রয়াস। ভবিষ্যতে আরো ভালো ভালো বিষয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে গঠনমূলক লেখা আশা করছি।
পরিশেষে আমার দৃষ্টিতে লেখকের এ বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি – গল্পের গঠনগত ঐক্য ও দৃঢ়তা, সূক্ষ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, বিভিন্ন পরিস্থিতির শব্দ চয়ন, চরিত্রগুলোর অনুভূতিব্যক্তকরণে বাস্তবতা এবং প্রসঙ্গক্রমে লেখকের নিজস্ব ও ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশে আরো বাস্তব ও বলিষ্ঠ কিন্তু সাহিত্যিক প্রকাশভঙ্গি।
স্বত্ব ও দায় লেখকের…